• ||
  • Wednesday, January 22nd, 2025
  • ||

ঈদ ও কোরবানি : আমাদের করণীয়

ঈদ ও কোরবানি : আমাদের করণীয়

আমিন ইকবাল

  • দুয়ারে কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। আগামী বুধবার সারা দেশে পালিত হবে মুসলিম জাতির অন্যতম এই ধর্মীয় উৎসব। ঈদের দিন মুমিন-মুসলিমরা আনন্দ উদযাপন করেন। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে খুশি ভাগাভাগি করেন। উচ্ছ্বাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে মেতে ওঠেন অনাবিল আনন্দে।
  • প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্ব থেকে এ উৎসব পালন করছে বিশ্ব মুসলিম সমাজ। রাসুল (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলেন, দেখেন সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দুদিন উৎসব পালন করেন। সে উৎসব সম্পর্কে নবীজি (সা.) জানতে চাইলে মদিনাবাসী বলেন, ‘জাহেলি যুগ থেকে আমরা এ দুদিন উৎসব পালন করে আসছি।’ পরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুদিনের বদলে আরও উত্তম দুদিন দিয়েছেন উৎসবের জন্য। সে দুদিন হলো- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।’ (আবু দাউদ : ১/১৬১)। সেদিনের পর থেকে মুসলিম জাতি বছরে দুটি ঈদ-উৎসব পালন করে আসছে স্বমহিমায়, সগৌরবে।
  •  
  • মুসলিমদের ঈদ যেমন আনন্দের; তেমনি ইবাদতেরও। ঈদের নামাজ, পশু কোরবানি, তাকবির প্রদানসহ বিভিন্ন আমল রয়েছে এদিন। তবে ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় আমল হলো আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করা। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ পরীক্ষা করেন- বান্দা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তার রবের জন্য। একই সঙ্গে সামর্থ্যবান ব্যক্তির সম্পদ থেকে পশু কোরবানির মাধ্যমে গরিবের ঘরেও আনন্দ বিলানোর ব্যবস্থা করেন আল্লাহ। তাই তো বিধান হয়েছে- কোরবানির গোশত মালিক একা খাবেন না- পাড়া-প্রতিবেশী অসহায়-গরিবকেও দিতে হবে। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা সুন্নত। একভাগ নিজের পরিবারের জন্য, একভাগ আত্মীয়-প্রতিবেশীদের জন্য, আরেকভাগ অসহায়-গরিবের জন্য। এভাবেই কোরবানি মুসলিম সমাজে উদ্যমতা তৈরি করে। ধনী-গরিবের পার্থক্য মিটিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে। ঈদের খুশিতে আন্দোলিত করে তুলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে।
  •  
  • কোরবানি মূলত ত্যাগের পরীক্ষা। এর মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা দেখেন না তোমাদের সম্পদ, দেখেন না তোমাদের বেশভূষা, দেখেন শুধুই তোমাদের অন্তর আর আমলে পরিশুদ্ধতা।’ (মুসলিম : ২৫৬৪)। অন্য হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈদুল আজহার আমলসমূহের মধ্যে কোরবানি করার চেয়ে অন্য কোনো আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। কেয়ামতের দিন কোরবানির এই পশুকে তার শিং, পশম ও খুরসহ সব কিছু উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে (কোরবানি) কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করো।’ (তিরমিজি : ১৪৯৩)।  আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোশত, আর না তাদের রক্ত, বরং তার কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সুরা হজ : ৩৭)। তাই কোনো বান্দা যদি লোক দেখানো বা গর্ব করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে কোরবানি দেয়- এতে তার সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের পাল্লা ভারী হবে। তাই সর্বাগ্রে নিয়তের শুদ্ধতা চাই। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোরবানি করা চাই।
  •  
  • হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা তথা কোরবানি করা থেকে কোনো আমলই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় নয়। নিশ্চয়ই কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, চুল ও খুরসহ উপস্থিত হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট পৌঁছে যায়। সুতরাং তা দ্বারা নিজেকে সুবাসিত ও সুরভিত করো।’ (তিরমিজি : ১/২৭৫)। অন্য বর্ণনায় আছে, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে সওয়াব দেওয়া হবে। (তিরমিজি : ১/২৭৫; মুসনাদে আহমাদ : ১৮৮৫৭; ইবনে মাজাহ : ৩১২৬)
  •  
  • ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি ছাড়া আরও যেসব আমল করতে হয়-
  • ঈদের দিন গোসল : ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। কারণ এ দিনে নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানরা ঈদগাহে একত্র হয়ে থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
  • উত্তম পোশাক ও সাজসজ্জা : উত্তম জামা-কাপড় পরে ঈদ উদযাপন করা। সামর্থ্য থাকলে নতুন পোশাক পরা, অন্যথায় নিজের পরিষ্কার উত্তম পোশাক পরা। হজরত নাফে (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দিন উত্তমভাবে গোসল করতেন, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করতেন, নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। অতঃপর নামাজে যেতেন। (শরহুস সুন্নাহ : ৪/৩০২)
  • ঈদগাহে যাওয়া : ঈদগাহে এক পথ দিয়ে যাওয়া ও অন্যপথ দিয়ে ফেরা সুন্নত। (বুখারি : হাদিস ৯৮৬) সম্ভব হলে ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়াও সুন্নত। (ইবনে মাজা : হাদিস ১০৭১)
  • ঈদের নামাজ আদায় : ঈদের দিন সকালে পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বিশেষ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত তাকবিরসহ জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা এবং তারপর ঈদের খুতবা দেওয়া ও শ্রবণ করা। ঈদের নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করা উত্তম।
  • ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- ১. হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামরা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অন্যকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। ২. ঈদ মোবারক ইনশাল্লাহ। ৩. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
  • ঈদের তাকবির পাঠ : তাকবির পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবির হলো- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহ আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ বাক্যটি উচ্চঃস্বরে পড়া। পুরুষরা এ তাকবির উঁচু আওয়াজে পাঠ করবে, মেয়েরা নীরবে। এ তাকবির জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার পাঠ করা ওয়াজিব। (ফাতহুল বারি : ২/৫৮৯)
  • ঈদে খাবার গ্রহণ : ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে খেতেন না।’ (তিরমিজি : ৫৪৫)
  • এতিম ও অভাবিকে খাওয়ানো : ঈদের দিন এতিমের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহার : ৮)
  • আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া : ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। পাশাপাশি প্রতিবেশীরও খোঁজখবর নেওয়া। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতাপিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাসদাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সুরা নিসা : ৩৬)
  • পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা : ঈদুল আজহায় পশুর রক্ত, আবর্জনা ও হাড় থেকে যেন পরিবেশ দূষিত না হয়, সেদিকে প্রত্যেকের সতর্ক হওয়া উচিত। কোরবানি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত, আবর্জনা ও হাড় নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা।
comment
Comments Added Successfully!