সৎ ও সুন্দর জীবন গঠনে যেসব পাপ পরিহার করা চাই
- জন্মগতভাবেই প্রতিটি মানুষ সৎ ও সুন্দর মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। ইসলামের প্রতিটি বিধানকে সহজে মেনে নেওয়ার মতো উদার হৃদয় মানুষের মাঝে বিদ্যমান থাকে। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ, বন্ধু-বান্ধব কখনও কখনও তাকে অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। খারাপ পথে পরিচালিত করে। তাই সৎ স্বভাব ও সুন্দর জীবনগঠনে নিম্নে বর্ণিত পাপ ও মন্দ থেকে বিরত থাকা চাই।
- অসৎসঙ্গ : মানুষের জীবনে সঙ্গীর প্রভাব অপরিসীম। কারণ সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্র ও মানসিকতা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। অসৎ লোকের সঙ্গে থাকতে থাকতে উপকারী বস্তুকে মন্দ মনে হতে থাকে। ধীরে ধীরে মন্দের পথে চলতে প্ররোচিত হয় মানুষ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩৩)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ সুগন্ধী বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের মতো। সুগন্ধী বিক্রেতার থেকে তুমি শূন্য হাতে ফিরে আসবে না। হয় তুমি আতর ক্রয় করবে, না হয় তার সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের হাপর হয় তোমার ঘর অথবা তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, না হয় তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি : ২১০১)
- মিথ্যা : মিথ্যা মানবজীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বদঅভ্যাস। মানুষের ব্যক্তিজীবন উন্নতির বিনাশক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। তিলে তিলে গড়ে তোলা সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবনকে মুহূর্তেই সে ধসিয়ে দেয়। মিশিয়ে দেয় মান-সম্মান। মিথ্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো সীমালঙ্ঘনকারী, মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত ব্যক্তিকে হেদায়াত দান করেন না।’ (সুরা মুমিন : ২৮)।
- রাসুল (সা.) মিথ্যার ভয়াবহতার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা উপনীত করে পাপাচারে। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে। আর মানুষ মিথ্যা বলতে বলতে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।’ (মুসলিম : ২৬০৭)। মা-বাবা যেহেতু সন্তানের প্রথম শিক্ষক তাই তাদের ওপর কর্তব্য হলো সন্তানকে শৈশবেই সত্য ও সততা শিক্ষা দেওয়া। সত্যের প্রাপ্তি সম্পর্কে জানান দেওয়া। মিথ্যার ভয়াবহতা ও ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।
- ধোঁকাবাজি : ধোঁকাবাজি করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অতি নিন্দনীয় অভ্যাস। সবাই ধোঁকাবাজকে নিচু চোখে দেখে। খারাপ মনে করে। মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি বিশ্বাস থাকে না। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে হয়ে যায় একাকী। এমনকি রাসুল (সা.) নিজে ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে, আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (মুসলিম : ১৮৫)। তাই মা-বাবার জন্য কর্তব্য হলো সন্তানকে বিশ্বাসের প্রতীক রূপে গড়ে তোলা। আস্থার ঐশ্বর্যে তাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তোলা। বিশ্বাসের ফুলে তার হৃদয় ভরপুর করে দেওয়া। তাহলেই এই সন্তান পৃথিবীর বুকে বিশ্বাসের ফুল ছড়াবে।
- গালাগাল : মানুষের কথাবার্তায় তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়। তার বংশের পরিচয় ফুটে ওঠে। সুতরাং সভ্য মানুষ কখনও কাউকে গালাগাল করে না। এতে নিজের ব্যক্তিত্ব যেমন নষ্ট হয় অন্যকে কষ্ট দেওয়া হয়। সন্তানকে তার শৈশবেই এই মন্দ স্বভাব থেকে রক্ষা করতে পারলে মানুষের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের নিকট সে হবে সম্মানের পাত্র। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা মুমিন নর ও মুমিন নারীদের বিনা অপরাধে কষ্ট দান করে, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহযাব : ৫৮)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি কাজ (জঘন্য পাপ) আর কোনো মুসলিমকে হত্যা করা কুফরি।’ (বুখারি : ৭০৭৬)
- পরনিন্দা : পরনিন্দা হলো সামাজিক শান্তি বিনাশক একটি ঘৃণ্য অপরাধ। বর্তমান সময়ে এটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। আল্লাহর ঘর মসজিদেও চলে পরনিন্দা। চলে এই ঘৃণ্য অপরাধের চর্চা। অথচ আল্লাহ সরাসরি আদেশ করেন এই অপরাধ থেকে দূরে থাকার। তিনি বলেন, ‘হে মুমিনগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না এবং একে অন্যের পরনিন্দা করবে না।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।
- পরনিন্দার শাস্তি সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মেরাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরি এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরিল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেত (পরনিন্দা করত) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানত। (আবু দাউদ : ৪৮৭৮)। সুতরাং সন্তান যেন পরনিন্দার মতো মন্দ অচরণে বেড়ে না ওঠে সেদিকে লক্ষ রাখা।
- হিংসা-বিদ্বেষ : হিংসা-বিদ্বেষ অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্বভাব। হিংসা অন্যের প্রতি অন্তর্জালা বৃদ্ধি করে। ফলে বিনা-কারণে অন্যের প্রতি শত্রুতার মনোভাব তৈরি হয়। হিংসুকের হৃদয়ে থাকে না কোনো প্রশান্তি। সারাক্ষণ সে হিংসার অনলে জ্বলতে থাকে। তাই মা-বাবা সন্তানকে হিংসা-বিদ্বেষমূলক ব্যাধি থেকে রক্ষা করবে। হিংসা-বিদ্বেষের অনল থেকে রক্ষা করে তাকে প্রশান্তময় জীবন উপহার দেবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, আগুন যেমন লাকড়িকে খেয়ে ফেলে হিংসা ঠিক তেমনি নেকি ও পুণ্যকে খেয়ে ফেলে।’ (আবু দাউদ : ৪৯০৩)।
- উপরে বর্ণিত পাপ ও মন্দ স্বভাব ছাড়াও আরও যেসব পাপ ও মন্দ স্বভাব মানবজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন প্রত্যেক পাপ ও মন্দ স্বভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করা জরুরি। আল্লাহ বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন।
- লেখক : হাবীবুল্লাহ আল মাহমুদ
- শিক্ষক, শাইখুল হিন্দ রহ. ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, সানারপাড়, নারায়ণগঞ্জ