লোকদেখানো নয়, কোরবানি হোক আল্লাহর জন্য
- কদিন পরেই ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার অন্যতম ইবাদত হলো, মহান আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করা। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। যেকোনো পরিস্থিতিতে এই বিধান পালন করতে হবে। আমাদের সমাজে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, পশু জবাই করাতো প্রাণির প্রতি অবিচার, প্রাণি হত্যা করা তো ঠিক না। তাছাড়া এখন করোনার ভয়াবহতা চলছে। এই সময়ে পশু জবাই না করে এই টাকা দিয়ে মানুষকে দান করলেই তো হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি...
- না, এমনটা করা যাবে না। দান করা আর কোরবানি করা এক জিনিস না। দান নফল ইবাদত আর কোরবানি ওয়াজিব। তাছাড়া পশু জবাইয়ের বিধান তো আল্লাহই দিয়েছেন। আর আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে কোনো মায়া-মমতা ও নিজস্ব অভিরুচি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কোরবানির উদ্দেশ্য। যেমন ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। পিতার প্রতি ছেলেকে কোরবানি করার নির্দেশের সামনে পিতা ইব্রাহিম (আ.) যেমনি কোনো প্রশ্ন তুলেননি, তেমনি সন্তান ইসমাইলও সম্পূর্ণরূপে আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিয়েছেন। যেহেতু হুকুম আল্লাহ তায়ালার সুতরাং এখানে আপত্তি করার কোনো অধিকার কারও নেই। কেননা সব কিছুর মালিক তো তিনিই। এই জীবনের মালিকও তিনি। ইবরাহিম (আ.) নিজেই করেছিলেন এমন উক্তি, ‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’ (সুরা আনআম : ১৬২)
- আল্লাহর নৈকট্য অর্জন :
- তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানি দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিনে কোনো আদম সন্তানের কোরবানির পশুর রক্ত প্রবাহিত করার থেকে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় কোনো আমল নেই। কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশু শিং, খুর, লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তার রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব, তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে কোরবানি কর।’ (ইবনে মাজাহ : ৩১২৬)
- আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা
- প্রত্যেক ইবাদতই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। কোরবানির মাধ্যমেও প্রকাশ করা হয় আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এভাবে তিনি এ চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং তারই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীকে সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ : ৩৪)
- ত্যাগের পরীক্ষা
- পৃথিবীতে ত্যাগী মানুষের বড্ড অভাব আদিকাল থেকেই। ত্যাগের স্থান দখল করে রেখেছে স্বার্থপরতা ও পরশ্রীকাতরতা। কোরবানি হলো একটি ত্যাগের পরীক্ষা। আল্লাহর বিধান পালনে জান-মালের ত্যাগ স্বীকার করার যোগ্যতা তৈরি হয়।
- কোরবানির ঈদকে শুধু গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত না করে বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ তথা লোভ ও স্বার্থপরতা ত্যাগ করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার একটি প্রস্তুতিমূলক আয়োজন। কারণ মুমিনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়, দারিদ্য, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতি করার মাধ্যমে পরীক্ষা করবো।’ (সুরা বাকারাহ : ১৫৫)
- সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
- কোরবানির মাধ্যমে সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা তৈরি হয়। একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করা ও কোরবানির গোশত গরিব-দুঃখী ও আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর মাঝে বণ্টনের মাধ্যমে তৈরি হয় সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহাবস্থান ও সামাজিক ঐক্যবদ্ধতার মানসিকতা।
- আর ইসলাম বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয় না বরং নির্দেশ দেয় ঐক্যবদ্ধতার। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমারা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০৩)। প্রতিবছর এই মহান শিক্ষার কথাই যেন কোরবানি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
- দারিদ্র্য বিমোচন
- কোরবানিতে গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়। যারা বছরে একবারও গোশত খেতে পারে না, তারাও গোশত খাওয়ার সুযোগ পায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা যায়। কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিকভাবে পশু পালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোরবানির চামড়ার টাকা গরিবের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী মানুষের নিত্যদিনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে কোরবানির পশু চামড়া অর্থনীতিতে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।