• ||
  • Wednesday, January 22nd, 2025
  • ||

ইসলামে রোজার বিধান যেভাবে এলো

ইসলামে রোজার বিধান যেভাবে এলো

নবুয়ত প্রাপ্তির পর নবীজির উপর যে সকল ঐশী বিধানাবলী অবতীর্ণ হয় তার অন্যতম হলো রোজা। এটি ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। নবীজী বলেন, পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল- এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, সলাত কায়িম করা, যাকাত দেয়া, বাইতুল্লাহর হজ করা ও রমজানের রোজা পালন করা। (মুসলিম: ২১)
ইসলামী শরীয়তের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, কোন বিধান পূর্ণ রূপে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধীরতা অবলম্বন করা। পরিস্থিতি বিবেচনা করা। মানুষের স্বভাব প্রকৃতি অনুধাবন করা। সামান্য তম ক্ষতি কিংবা সমস্যার সৃষ্টি না হওয়ার প্রতি লক্ষ্য রাখা। তেমনি একটি বিধান হলো রোজা। কোরআনের আয়াত ও নবীজির একাধিক হাদিসের নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রোজা তিনটি ধাপ অতিক্রম কওে চূড়ান্ত ফরজ বিধান সাব্যস্ত হয়েছে।

প্রথমধাপ
ইবনে কাসীর (রহ.) বর্ণনা করেন, যখন নবীজি মদীনায় আগমন করেন তখন তিনি প্রতি মাসে তিন দিন এবং আশুরার দিন রোজা রাখতে শুরু করেন। এসময় মুসলমানদের ওপর কোন রোজা আবশ্যক ছিলনা। তবে নবীজি আশুরার রোজার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং সবাইকে তা রাখারও নির্দেশ দেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) মাদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদিরা আশুরার দিনে সওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সওম পালন কর কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা আলাবনী ইসরাঈলকে তাদেও শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আ.) সওম পালন করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, আমি তোমাদেও অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে সওম পালন করেন এবং সওম পালনের নির্দেশ দেন। (বুখারি: ২০০৪)
যখন নবীজি (সা.) দ্বিতীয় হিজরীতে পদার্পণ করেন তখন রোজার ফরজ বিধান অবতীর্ণ হয় এবং প্রতি মাসের তিন রোজা ও আশুরার রোজার হিত হয়ে যায়। নবীজি বলেন, রমজানের রোজা অন্য সব রোজাকে রহিত করে দিয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) মদিনায় আগমনের পর আশুরার রোজা রেখেছেন এবং লোকদেও তা রাখারও নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু যখন রমজানের রোজা ফরজ হল, তিনি ঘোষণা করে দিলেন, আশুরার রোজা যার ইচ্ছা রাখবে, যার ইচ্ছা রাখবেনা।

দ্বিতীয়ধাপ
আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজা ফরয ঘোষণা কওে তিনটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। তবে তা একবারে নয়; পৃথক পৃথক সময়ে। প্রথম দুটি হল,‘হে ঈমানদার গণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদেও পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।’
‘গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদেও মধ্যে যে অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ কওে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্তকষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সাথে সৎকর্ম করে, তাতার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদেও জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩, ১৮৪)
এই আয়াত দ্বয়ে বলা হয়েছে, অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির জন্য রোজা ভাঙার অনুমতি আছে এবং পরবর্তীতে তারা সুস্থ  হলে কিংবা সফর শেষ হলে ভাংতি রোজা কাজা কওে নিবে। আর যে ব্যক্তি মুসাফিরনা, অসুস্থওনা; বরং সুস্থ-সবল ও স্থায়ী নিবাসী সে ইচ্ছাধীন। চাইলে রোজা রাখতে পারে, চাইলে না রেখে তার পরিবর্তে ফি দিয়া তথা বিনিময় দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারে।
মুআজ (রা.) বলেন, শুরুর দিকে কেউ চাইলে রোজা রাখত, চাইলে রোজা না রেখে প্রতিদিন একজন মিসকীনকে আহার করাতো।
ইমাম বুখারি (রহ.) সহ আরো অনেকে অবতীর্ণ আয়াতের এই অংশ-‘আর এটি যাদের জন্য অত্যন্তকষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে’Ñ থেকে প্রমাণ গ্রহণ করে এর স্বপক্ষে অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন।
তারপর অবতীর্ণ হল তৃতীয় আয়াতÑ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল কর াহয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদেও মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজারা খবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেননা যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহতা'আলারমহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)
লক্ষণীয় যে, আয়াতে কারা সক্ষম, কারা অক্ষমÑএমন কিছ ুউল্লেখ নেই। এ থেকে ইমাম বুখারী (রহ.) অসংখ্য সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এই আয়াত পূর্বেও আয়াতকে রহিত করে দিয়েছে। এবং রোজা রাখতে সক্ষম- এমন সব ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক করেছে। অর্থাৎ রমজান মাস উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোজা রাখতে হবে। পূর্বেও ন্যায় কারোর কোন ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি বিবেচিত হবেনা।

তৃতীয়ধাপ
এই স্তরে এসে রোজার সময় নির্ধারণ হয়; কখন রোজাদার বৈধ-অবৈধ সব কাজ থেকে বিরত থাকবে, এবং কখন বৈধ কাজ গুলো করার সুযোগ লাভ করবে। প্রথমদিকে দিনের বেলায় যেমন রোজার বিধান প্রযোজ্য হত, রাতে ও সমান ভাবে রোজার সব বিধান কার্যকর হতো। যেমন মানুষ যখন এশার নামাজ থেকে অবসর হতো তাদের জন্য পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকা আবশ্যক ছিল। একবার ঘুমিয়ে গিয়ে-হোক তা এশারের আগে- পুনরায় জাগ্রত হলে তার ওপর রোজার বিধান প্রযোজ্য হয়ে পড়তো।
এক কথায় ঘুম কিংবা এশার নামাজ- কোন একটিতে কেউ লিপ্তহলে তার জন্য সারারাত ও পরের সারাদিন সন্ধ্যাপর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকা অত্যাবশ্যক ছিল।
এমতাবস্থায় তখনকার মুসলমানদের পক্ষে বিধানটি কঠিন ও জটিল সাব্যস্ত হয়। দেখা গেল যদি ইফতারের পূর্বেও কেউ ঘুমিয়ে পড়তো, পর দিন ইফতার পর্যন্ত তার জন্য আহার-পানি থেকে বিরত থাকা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকতনা।
একবার সাহাবী কাইসইবনে সিরমাহ (রা.) রোজা রেখে ছিলেন। তিনি সে দিন তার ফসলিজ মিনে কাজ করেছিলেন। কাজ শেষে বাড়ি ফিরলেন ইফতারের সময়। তার স্ত্রী তার জন্য ইফতার প্রস্তুত করতে গেলেন। কিন্তু ফিওে এসে দেখলেন, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। মধ্য রাতে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায় এবং গভীর নিদ্রার বসে স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়ে পড়েন। পরদিন তিনি নবীজির কাছে ঘটনা বর্ণনা করেন। তখন আল্লাহ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করেন,‘রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদেও পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদেও পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্ম প্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, ত াআহরণ কর। আর পানাহার কর যতক্ষণনাকাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত...।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)। এতে সবাই যারপর নাই আনন্দিত হয় এবং সে থেকে আজ অবধি সে বিধানটি বহাল তবিয়তেরয়ে যায়। আমরা আজও সে বিধান অনুযায়ী রোজা পালন করছি।
 

comment
Comments Added Successfully!