মিথ্যা যেভাবে ক্ষতি ডেকে আনে
- মিথ্যা মানুষকে পাপ ও অপরাধের প্রতি উৎসাহী করে তোলে। একটি মিথ্যাকে চাপা দিতে অসংখ্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। মূলত মিথ্যার ওপর ভরসা করেই মানুষ অপরাধ করার সাহস পায়। মিথ্যাবাদীকে কেউ পছন্দ করে না, এমনকি অতি আপনজনও। আল্লাহ তায়ালা মিথ্যাবাদীকে অভিশাপ করেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ (সুরা আলে ইমরান : ৬১)। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মিথ্যা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘এবং তোমরা মিথ্যা কথা পরিহার কর।’ (সুরা হজ : ৩০)।
- মিথ্যা কোনো প্রকৃত মুমিনের স্বভাব হতে পারে না। যিনি মুমিন তিনি সত্যবাদী। সত্য আর মিথ্যা দুটি বিপরীতধর্মী জিনিস। এ দুটি কখনও এক ব্যক্তির মধ্যে সমাবেশ ঘটতে পারে না। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ঈমানদার কি ভীরু হতে পারে? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। তাঁকে আরও জিজ্ঞাসা করা হলো, ঈমানদার কি কৃপণ হতে পারে? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হলো, ঈমানদার কি মিথ্যাবাদী হতে পারে? তিনি বললেনÑ না।’ (মুয়াত্তা : ৩৬৩০)। মিথ্যা বলার পরিণাম খুবই ধ্বংসাত্মক। মিথ্যা মিথ্যাবাদীকে জাহান্নামি বানিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা মিথ্যাচার হতে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপাচারের পথ দেখায় আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহর দরবারে তাকে বড় মিথ্যুক বলে লেখা হয়।’ (বুখারি : ৫৭৪৩)। মিথ্যার কারণে আল্লাহর বরকতে ঘাটতি সৃষ্টি করে। মিথ্যা সাময়িক সুবিধা ও লাভজনক মনে হলেও এর অভ্যন্তরীণ ক্ষতি অনেক বেশি। ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্যবসায় লাভবান হওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, এতে ব্যবসায়িক মুনাফার বরকত কমে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ে মিথ্যা কসম করা থেকে বিরত থাক। কেননা এর কারণে পণ্য বেশি বিক্রি হলেও বরকত কমে যায়।’ (মুসলিম : ১৫৬০)।
- মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা মূলত চারটি বড় গুনাহে লিপ্ত হয়। প্রথমত, সে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলে। দ্বিতীয়ত, সে যার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তার ওপর জুলুম করে। তৃতীয়ত, সে যার পক্ষে সাক্ষ্য দেয় তার জন্য হারাম কর্মের ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে তার জন্য জাহান্নাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং চতুর্থত, সে মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে একজনের সম্পদ বা হকের ওপর অন্যের হস্তক্ষেপ বৈধ বানিয়ে দেয়। অতএব মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হারাম ও কবিরা গুনাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে অবগত করব না? তা হলো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা।’ (বুখারি : ৬৪৬০)।
- সাধারণত মিথ্যা দু’ধরনের হতে পারে। প্রথমত, মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, নিজের লাভ অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে অথবা পাপাচারের শাস্তি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে। এটা নাজায়েজ ও হারাম। দ্বিতীয়ত, বিবদমান দুই ব্যক্তি বা দুদলের সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অথবা কোনো মুসলমানের কল্যাণার্থে কিংবা কোনো সৎ উদ্দেশ্যে অন্যের ক্ষতি ছাড়া এমন কোনো বৈধ বিষয়, যা মিথ্যা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়, তা হলে সেখানে কৌশলে মিথ্যা বলা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দেয় সে মিথ্যাবাদী নয়। সে ভালো কথা বলে এবং উত্তম কথাই আদান-প্রদান করে।’ (বুখারি : ২৬৯২)। অন্যত্র রাসুল (সা.) তিনটি ক্ষেত্রে চতুরতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন- ১. যুদ্ধে কৌশল অবলম্বনের ব্যাপারে ২. লোকের বিবাদ মিটিয়ে সন্ধি স্থাপনে ৩. স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কথোপকথনে।’ (মুসলিম : ২৬০৫)।
- মিথ্যা মুনাফেকি স্বভাব। মিথ্যা দ্বারা মানুষের আদালত, সততা ও গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুনাফেকদের নিদর্শন তিনটি : কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা।’ (বুখারি : ২৬৮২)। ইসলামে শরীয় সমর্থিত কৌতুক, আনন্দ ও বিনোদনকে বৈধ করা হয়েছে। তাই বলে মিথ্যা বলা বৈধ করা হয়নি। আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে হাস্য-রসিকতা করতেন, কিন্তু মিথ্যা পরিহার করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস!’ (তিরমিজি : ২৩১৫)।