• ||
  • Wednesday, January 22nd, 2025
  • ||

সফর মাস : করণীয় ও বর্জনীয়

সফর মাস : করণীয় ও বর্জনীয়

আবদুল আজিজ

শুরু হলো সফর মাস। সফর হিজরি বর্ষের দ্বিতীয় মাস। ইসলাম নানা কারণে নানা সময়, দিন ও মাসকে বিশেষায়িত করলেও সফর মাস সেসবের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং বিশুদ্ধ ঈমানের সঙ্গে আল্লাহর হুকুমগুলো পালন করা, সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা, আইয়ামে বিজ তথা আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখা, সর্বোপরি সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকার মধ্য দিয়ে এ মাসও হয়ে উঠতে পারে অনেক মূল্যবান। তাই নিত্য নফল ও অন্যান্য মাসের আমলের মতো এ মাসেও আমল করতে কোনো বাধা নেই।
     
তবে ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে সফর মাসকে ঘিরে ছিল নানা ধরনের কুসংস্কারের ছড়াছড়ি। মানুষ মনে করত, যত অশুভ, অকল্যাণ, বিপদাপদ সব নেমে আসে এ মাসে। এ মাসে বিয়ে শুভ হয় না। ব্যবসা মন্দা যায়। অন্যত্র যাত্রা অমঙ্গল হয়। এ ছাড়াও শিষ্ট-অনিষ্ট, সৎ-অসৎ, রোগ সংক্রমণ এবং আঞ্চলিক ভাষায় ছাঁৎ-কুছাঁৎ যাবতীয় বহু কুধারণার শিকার ছিল তারা। ইসলাম এসব কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর যখন শুভদিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, এটাই আমাদের জন্য উপযোগী। আর যদি অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয় তবে তাতে মুসার এবং তার সঙ্গীদের অলক্ষণ বলে অভিহিত করে...।’ (সুরা আরাফ : ১৩১)। আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে কুলক্ষণ, অশুভ সব বিষয়ের নিন্দা করেছেন এবং এসব অসার ধারণা যে সব যুগেই ছিল- তারও প্রমাণ মিলে আয়াত থেকে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সংক্রমক ব্যাধি, কুলক্ষণ, অনাহারে পেট কামড়ানো পোকা ও হামাহ- এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই।’ (মুসলিম : ৫৬৮২)
     
জাহেলি যুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন এসব কুসংস্কারকে গ্রহণ ও যোগ্যতা দিতে কেউ কেউ আবার অসার জাল হাদিসও তৈরি করে ফলেছে। এমন একটি হাদিস হলো, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস শেষ হওয়ার সুসংবাদ দেবে, আমি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেব।’ অর্থাৎ স্বয়ং রাসুল (সা.) সফর মাসের শিগগিরই অবসান কামনা করেছেন। কারণ এটি অশুভ মাস। তাই তো এ মাসে বেশি বেশি নফল ইবাদত করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির সমুদয় অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে হবে। হাদিস সম্পর্কে প্রথম কথা হলো, হাদিসটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও জাল। রাসুল (সা.) থেকে আদৌ এরকম কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি। ফাতাওয়া হিন্দিয়া ও জাওয়াহিরুল ফাতওয়ায় স্পষ্ট করে বলা আছে, এটি কোনো হাদিস নয়। নিরেট মিথ্যা কথা।
দ্বিতীয় কথা হলো, তর্কের খাতিরে যদি হাদিসটির শুদ্ধ অস্তিত্ব স্বীকারও করা হয় তবু সেখানে ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। মূলত হাদিসটি একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) বলেছেন। তা হলো- একবার হজরত আবু বকর (রা.) ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূরের এক জনপদে সফরে যান। সে সফর থেকে ফিরতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল বলে রাসুল (সা.) চিন্তিত হয়ে পড়েন। ওই সময় একটি চিঠি এলো, তাতে লেখা- ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি সফর মাস শেষে মদিনায় ফিরব।’ কিন্তু তখনও সফর মাসের বেশ সময় বাকি। তাই তিনি আবু বকর (রা.)-এর অপেক্ষার কষ্ট লাঘব করতে হাদিসটি বলেছেন।
     
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই আধুনিক যুগে এসেও এক শ্রেণির মানুষ এসব কুসংস্কারের আবহ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। স্থান ও সময়ের ব্যবধানে হয়তো ধরনে পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ মাসকে ঘিরে যে কটি কুসংস্কার লক্ষণীয় তার অধিকাংশ মানুষের ঈমান-আকিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘আখেরি চাহার শম্বাহ’। এটি একটি ফার্সি শব্দ। যার অর্থ মাসের শেষ বুধবার। কথিত আছে, নবীজি (সা.) সফর মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাসের শেষ বুধবারে খানিকটা সুস্থতা বোধ করেন এবং এ দিনে সাত মশক পানি দ্বারা গোসল করেন। এ ঘটনায় সাহাবায়ে কেরাম যারপরনাই আনন্দিত হন। সব সাহাবা অনেক দান-সদকা করেন।
     
এ গল্পটির গ্রহণযোগ্য কোনো ভিত্তি নবীজির হাদিসে, সাহাবায়ে কেরাম কিংবা তাবেয়িদের বক্তব্যে আদৌ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক শ্রেণির অসতর্ক বক্তা এসব মুখরোচক ঘটনা বানিয়ে শ্রোতাদের কাছে পরিবেশন করে। নবীজি (সা.) অসংখ্য বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন জীবদ্দশায়। সে জন্য নবীজির (সা.) জীবদ্দশায় বা ইন্তেকালের পর কোনো সাহাবা বছর বছর বিপদমুক্তির দিবস পালন করেছেন- এমন নজির মেলেনি আজ অবধি। অথচ আমাদের দেশে এ নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়ে যায়। কত গল্প কত আমল প্রচলিত রয়েছে আমাদের সমাজে। এসব ইবাদতের সওয়াব অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি পাওয়ার বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। প্রকারান্তরে এসব রেওয়াজ শিরক-বিদআতের দিকে নিয়ে যায়। কারণ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ আমাদের এ শরিয়তে নেই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারি : ২৬৯৭)। নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘দ্বীনের ভেতর নব আবিষ্কার থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়।’ (আবু দাউদ : ৪৬০৭)
     
প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য হলো, শিরক-বিদআত বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভ করা এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। মনে রাখতে হবে, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষণ অমূল্য রত্ন। দিন, মাস ও বছরের পিঠে চড়ে যা এগিয়ে চলছে অবিরত। সময়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি মানুষ তার ঠিকানা করে নেয়- জান্নাত বা জাহান্নাম। সুতরাং সময়ের ভেতর শুভ-অশুভের দেয়াল তুলে কখনও ইবাদতে মগ্ন হওয়া, কখনও ছেড়ে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

comment
Comments Added Successfully!